ইয়াবার নতুন রুট এখন আকাশপথ

আবুল খায়ের :

ইয়াবা (ফাইল ছবি)

ইয়াবা পরিবহনে নিত্য নতুন ও অভিনব কৌশল অবলম্বন করছে ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম, টেকনাফ-কক্সবাজার থেকে রাজধানীতে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক আসার খবর নতুন নয়। সড়ক, রেল কিংবা নৌপথে মাদকের চালান এলেও বেশ কিছুদিন ধরে তা আসছে আকাশপথে।

র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সড়ক, রেল ও নৌপথে নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় কৌশল পাল্টে আকাশপথকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেঁছে নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার থেকে ইয়াবা আকাশপথে রাজধানীতে আসছে। সেগুলো আবার অভ্যন্তরীন ফ্লাইটে সারাদেশে চলে যাচ্ছে।

দেশের বাইরেও যাচ্ছে ইয়াবা। মাদক কারবারিদের আকাশ পথ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিমানবন্দর ও এয়ালাইন্সের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এক শ্রেণীর ক্রু ও বিমানবালাও জড়িত। বিমানবন্দরে স্ক্যানার আছে। সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিদ্যমান। তিন শিফটে ১৮টি সংস্থা বিমানবন্দরে দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। এতো নিরাপত্তার মধ্যেও মাদক আসছে বিমানে। এর কারণ হিসেবে বিমানবন্দর ও এয়ারলাইন্সের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মাদকের একটি চালান পাচার করলে একদিনে যে পরিমাণ মাসোহারা পাওয়া যায়, তা তিন মাসের বেতনের সমান। সম্প্রতি আকাশপথে আসা বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও মাদকসহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ে অর্ধশত কারবারি।

র‌্যাব বলছে, ইয়াবা পরিবহনের রুট হিসেবে আকাশ পথ বেঁছে নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের ভিতরে তো আমরা অভিযান চালাতে পারি না।

জিরো টলারেন্স, মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান, ক্রসফায়ার, ইয়াবার কারখানা ধ্বংস, ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ, আইন সংশোধন, সীমান্তে কড়া নজরদারি। কোনো কিছুতেই থামছে না ইয়াবার পাচার। একের পর এক ইয়াবার চালান দেশে ঢুকছে। পুরাতন রুট পরিবর্তন করে নতুন রুট। অতি লাভজনক হওয়াতে এ ব্যবসায় যোগ দিচ্ছেন নতুন নতুন মুখ। ইয়াবার চাহিদাও বেড়েছে। দেশের অভিজাত এলাকা হয়ে পাড়া-মহল্লা ছাপিয়ে মাদকের ভয়াল থাবা শহর থেকে শুরু করে এখন গ্রামের ঘরে ঘরে। ভয়াল মাদকাসক্তি তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। নষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন। এছাড়া উঠতি বয়সীরা নেশাগ্রস্ত হয়ে গড়ে তুলছেন পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং। আর ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা একে অপরকে খুন করছে| ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তরুন প্রজন্ম।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য, সরকারি বিভিন্ন বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইয়াবায় আসক্ত। অর্থাৎ ইয়াবায় আসক্ত নয় এমন কোন পেশার লোক নেই। স্কুল-কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ইয়াবায় আসক্তদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যা মেধা ধ্বংসের বিপদজনক মাত্রা। আবার কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও ইয়াবায় আসক্ত। অর্থাৎ যিনি শিক্ষা দেবেন এবং যিনি শিক্ষা গ্রহণ করবেন-দুই পক্ষই মাদকাসক্ত হলে শিক্ষার কী হাল হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে, অর্থাৎ চালকদের অনেকেই মাদকাসক্ত। ইয়াবা খেয়ে দীর্ঘ সময় গাড়ি চালায়, অনিন্দ্রায় থাকে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা মাদক পরিবহনের রুট পরিবর্তন করে এখন আকাশ পথ বেঁছে নিয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এই কারণেই তারা আকাশ পথ ব্যবহার করছে। র‌্যাব বিমানবন্দরের বাইরে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাড়িয়েছে।

বিমানবন্দরে নিয়োজিত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা পাচারে আকাশপথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাস্টমস সহ বিভিন্ন বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। তবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে সম্প্রতি ইয়াবা পাচারকারিরা ধরাও পড়ছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে। বিমানবন্দরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এখন আকাশ পথে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। সর্বনাশা মাদক যুব সমাজের জন্য অশনিসংকেত।

মনোরোগ বিজ্ঞানীরা বলেন, দেশে যে হারে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে তা অশনিসংকেত। মাদকের কারণে অপরাধ বাড়ছে। ইয়াবাসহ মাদকাসক্তদের ব্রেনের সমস্যাসহ নানা রোগ ব্যাধি হচ্ছে। তরুণরা বেশি মাদকাসক্ত। এ কারণে তরুণরাই রোগ ব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত। মাদকাসক্তদের করোনায় আক্রান্তের হারও বেশি। মাদকের আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষায় অভিভাবক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ মাদক যুব সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। আর কোন দেশের যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে গেলে সেই দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার।

সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ২০ হাজার পিস ইয়াবাসহ শাহরিয়ার পারভেজ, জাহাঙ্গীর, নেপাল পাল ও হাবিব নামে চার মাদক কারবারিকে আটক করে র‌্যাব। বেসরকারি একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালানটি ঢাকায় আনেন শাহরিয়ার। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে চালানটি সরবরাহের সময় ওই চারজনকেই আটক করা হয়।

শাহরিয়ারকে তল্লাশি করে তার কোমরে থাকা বেল্টে ইয়াবাগুলো পাওয়া যায়। শাহরিয়ার অসংখ্যবার বিমানযাত্রী হয়ে ঢাকা-কক্সবাজার যাতায়াত করেছেন। একবার গেলেই ২০-২৫ হাজার পিস ইয়াবা আনেন। কখনো দিনে দুবারও কক্সবাজার-ঢাকা যাতায়াত করতেন তিনি। গত ৩১ জানুয়ারি এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ আটক করে রইছ মিয়া নামে এক মাদক কারবারীকে।

তার কাছে থেকে উদ্ধার করা হয় ৬৫৫ পিস ইয়াবা। গত ৯ নভেম্বর বিমানবন্দরে ২১টি প্লাস্টিক ও কালো টেপ দিয়ে বানানো নকল খুরমা খেজুরের ভেতরে করে পাচারকালে এক হাজার ৫০ পিস ইয়াবাসহ চার যাত্রীকে আটক করে এপিবিএন। গ্রিন চ্যানেল পার হওয়ার সময় তাদের আটক করা হয়।